হালাল আয়, ইবাদত কবুল হবার অন্যতম শর্ত। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি - বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিচের পদের লোকদের এতই কম বেতন দেয়া হয় যে, তারা শুধু কোন রকমে বেঁচে থাকে। আর উপরের স্তরের লোকদের এত বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় যে, তারা খরচ করার ক্ষেত্র না পেয়ে, একের পর এক বাড়ি-প্লাট ক্রয় করতে থাকে। আর তারা মনে করে, তাদের আয় হালাল। কোন কোন ক্ষেত্রে বেতনের অনুপাত ১ঃ১৫ এরও বেশি , আর সুযোগ-সুবিধা ১ঃ১০০ কেও ছাড়িয়ে গেছে।
![]() |
ইসলামে দৃষ্টিতে হালাল আয় ও মুজুরী নীতি কি? |
হালাল আয় ও মুজুরী নীতি
অফিসের উপরের স্তরের কর্মকর্তা কি কখনও ভেবে দেখেছে, তাদের নিম্ন স্তরের লোকেদের যে বেতন দেয়া হয়, তা দ্বারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় কিনা? এত কম বেতনে তারা চলে কি করে?
আমরা মনে করি, নিম্ন স্তরের লোকদের শোষণ করে, উপরের স্তরের কর্মকর্তাদের ঢেলে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দেয়া ন্যায়ের পরিপন্থী।
১। পবিত্র কোরআনে ভালো কাজের মুজুরী দ্বিগুণ
পবিত্র কোরআনে কাজের বিনিময়ে, পুরস্কার অথবা শাস্তি দ্বিগুণ দেয়ার কথা অনেক বার বলা হয়েছে। যেমনঃ
ভালো কাজের বিনিময়ে, পুরস্কার দ্বিগুণ সম্পর্কেঃ
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ক) সূরা আন নিসা (النّساء), আয়াত: ৪০
إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِن تَكُ حَسَنَةً يُضَٰعِفْهَا وَيُؤْتِ مِن لَّدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا
অর্থঃনিশ্চয়ই আল্লাহ কারো প্রাপ্য হক বিন্দু-বিসর্গও রাখেন না; আর যদি তা সৎকর্ম হয়, তবে তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে বিপুল সওয়াব দান করেন।
খ) সূরা আর রাহমান (الرّحْمن), আয়াত: ৪৬
وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِۦ جَنَّتَانِ
অর্থঃযে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে পেশ হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্যে রয়েছে দু’টি উদ্যান।
গ) সূরা আল-হাদীদ (الحديد), আয়াত: ২৮
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَءَامِنُوا۟ بِرَسُولِهِۦ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِن رَّحْمَتِهِۦ وَيَجْعَل لَّكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِۦ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَٱللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থঃমুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। তিনি নিজে অনুগ্রহের দ্বিগুণ অংশ তোমাদেরকে দিবেন, তোমাদেরকে দিবেন জ্যোতি, যার সাহায্যে তোমরা চলবে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।
ঘ) সূরা আর রুম (الرّوم), আয়াত: ৩৯
وَمَآ ءَاتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَا۟ فِىٓ أَمْوَٰلِ ٱلنَّاسِ فَلَا يَرْبُوا۟ عِندَ ٱللَّهِ وَمَآ ءَاتَيْتُم مِّن زَكَوٰةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ ٱللَّهِ فَأُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُضْعِفُونَ
অর্থঃমানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে, অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে।
২। পবিত্র কোরআনে পাপ কাজের শাস্তি দ্বিগুণ
পাপ কাজের শাস্তি দ্বিগুণ সম্পর্কেঃ
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ক) সূরা আল আহ্যাব (الْأحزاب), আয়াত: ৬৮
رَبَّنَآ ءَاتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ ٱلْعَذَابِ وَٱلْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا
অর্থঃহে আমাদের পালনকর্তা! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা অভিসম্পাত করুন।
খ) সূরা আল আরাফ (الأعراف), আয়াত: ৩৮
قَالَ ٱدْخُلُوا۟ فِىٓ أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُم مِّنَ ٱلْجِنِّ وَٱلْإِنسِ فِى ٱلنَّارِ كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَّعَنَتْ أُخْتَهَا حَتَّىٰٓ إِذَا ٱدَّارَكُوا۟ فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَىٰهُمْ لِأُولَىٰهُمْ رَبَّنَا هَٰٓؤُلَآءِ أَضَلُّونَا فَـَٔاتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِّنَ ٱلنَّارِ قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَٰكِن لَّا تَعْلَمُونَ
অর্থঃআল্লাহ বলবেনঃ তোমাদের পূর্বে জিন ও মানবের যেসব সম্প্রদায় চলে গেছে, তাদের সাথে তোমরাও দোযখে যাও। যখন এক সম্প্রদায় প্রবেশ করবে; তখন অন্য সম্প্রদায়কে অভিসম্পাত করবে। এমনকি, যখন তাতে সবাই পতিত হবে, তখন পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক এরাই আমাদেরকে বিপথগামী করেছিল। অতএব, আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন। আল্লাহ বলবেন প্রত্যেকেরই দ্বিগুণ; তোমরা জান না।
গ) সূরা হুদ (هود), আয়াত: ২০
أُو۟لَٰٓئِكَ لَمْ يَكُونُوا۟ مُعْجِزِينَ فِى ٱلْأَرْضِ وَمَا كَانَ لَهُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِنْ أَوْلِيَآءَ يُضَٰعَفُ لَهُمُ ٱلْعَذَابُ مَا كَانُوا۟ يَسْتَطِيعُونَ ٱلسَّمْعَ وَمَا كَانُوا۟ يُبْصِرُونَ
অর্থঃতারা পৃথিবীতেও আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই, তাদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তি রয়েছে; তারা শুনতে পারত না এবং দেখতেও পেত না।
ঘ) সূরা ছোয়াদ (ص), আয়াত: ৬১
قَالُوا۟ رَبَّنَا مَن قَدَّمَ لَنَا هَٰذَا فَزِدْهُ عَذَابًا ضِعْفًا فِى ٱلنَّارِ
অর্থঃতারা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, যে আমাদেরকে এর সম্মুখীন করেছে, আপনি জাহান্নামে তার শাস্তি দ্বিগুণ করে দিন।
সুতরাং প্রতিদান বা মুজুরী দ্বিগুণ হওয়ার বর্ণনা পবিত্র কোরআনেই রয়েছে।
৩। হাদীসে বেতন বৈষম্য দ্বিগুণ
ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাসূল সঃ ও খোলাফায়ে রাশেদার আমলে বেতন বৈষম্য ১ঃ২, আর সুযোগ সুবিধা সবার সমান হতে দেখা গেছে।সুতরাং সর্বোচ্চ বেতন ১লক্ষ টাকা হলে, সর্বনিম্ন বেতন ৫০ হাজার টাকা হতে হবে। আর সুযোগ সুবিধা সবার সমান করতে হবে। তবেই রাসূল সঃ ও খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নতের উপর আমল করা হবে।
এই নিয়মের ব্যতিক্রম করা মুনাফেকি ও বিদয়াত।
আবার গনিমতের মাল বন্টনে, অশ্বারোহী পায় পদাতিকের দ্বিগুণ।সুতরাং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মুজুরী বা বেতনের অনুপাত ১ঃ২ এর বেশি হওয়া কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী।
৪। কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য
ইসলামে কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার কোন বৈষম্য নাই।
রাসুলুল্লাহ সঃ বলেছেন, "তোমরা কখনও মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা অন্যে ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা তোমরা নিজের জন্য পছন্দ কর।" (যদিও তোমার মুসলিম ভাইয়ের যোগ্যতা তোমার চেয়ে কম)- বোখারী শরীফ।
রাসুলুল্লাহ সঃ আরো বলেছেন, "তোমরা যা খাবে, তোমাদের অধীনস্তদের তাই খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে, তোমাদের অধীনস্তদের তাই পরাবে।"
সুতরাং আমরা বলতে পারি, ইসলামে কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার কোন বৈষম্য নাই।
৫। ইসলামী অর্থনীতির মূল নীতি
ইসলামী অর্থনীতির মূল নীতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআর শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেন -
তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান, ধনসম্পদ কেবল তাদের মধ্যেই যেন আবর্তিত না হয়। - সূরা হাশরঃ৭।
তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান, ধনসম্পদ কেবল তাদের মধ্যেই যেন আবর্তিত না হয়। - সূরা হাশরঃ৭।
মুসলমানদের মধ্যে কোথায় সে আদর্শ। তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে শুধু শোষণ করার প্রতিযোগিতা। আরো বলে, "এখানে ভালো না লাগলে অন্য কোথাও চলে যাও।" তারা কি ভেবে দেখেনা যে, তার অধীনস্ত লোক যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, তার সমস্যা আছে। যার কারণে তারা চলে যাচ্ছে।
মুসলমানদের মধ্যে অনেক কর্মকর্তা প্রচুর টাকা বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ে একের পর এক বাড়ি - প্লাট করে, আর মনের সুখে গান করে,
"পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয় (০৯),
আর একটা বাড়ি-প্লাট হলে ১০ হয়।"
তারা কি ভেবে দেখেনা যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মচারীর মাথা গোজার একটা ঠিকানা নেই।
"পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয় (০৯),
আর একটা বাড়ি-প্লাট হলে ১০ হয়।"
তারা কি ভেবে দেখেনা যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মচারীর মাথা গোজার একটা ঠিকানা নেই।
ইসলামী অর্থনীতির মূল নীতি অস্বীকার করার কারণে, আমরা সমাজে ধনসম্পদের অনেক বড় বৈষম্য দেখতে পাই।
৬। উন্নত দেশে বেতনের অনুপাত
যেখানে উন্নত দেশে বেতনের অনুপাত ১ঃ৫ অথবা ১ঃ৬। উন্নত দেশের সরকার, নিম্ন আয়ের লোকদের কথা চিন্তা করে এই অনুপাত সৃষ্টি করেছে। ফলে উন্নত দেশের নিম্ন স্তরের লোকজন, অন্যায় কাজে জড়িত না হয়ে স্বাভাবিক জীবন করতে পারে। এজন্য উন্নত দেশে দুর্নীতি কম।
সেখানে আমাদের দেশ সহ অনেক দেশে নিম্নস্তরের লোকদের সামান্য বেতন দিয়ে, তাদের অন্যায় কাজে জড়িত হতে বাধ্য করা হয়।
৭। হালাল আয়
আমরা মনে করি, উপরের স্তরের লোকদের ঢেলে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া পবিত্র কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী। আর মুজুরী বা বেতন বৈষম্য পবিত্র কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত ১ঃ২ এর বেশি হলে, বেশি আয়টা হালাল হবে না। আবার যেসকল আয় ইসলাম বিরোধী, তাও হালাল নয়। যেমনঃ দুর্নীতি, প্রতারণা, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ হারাম।
৮। দুর্নীতি বিস্তারের কারণ
ক) আপনার সামনে দিয়ে যখন আপনার বস ২০০০টাকা দিয়ে বোয়াল মাছ ও অন্যান্য মাছ / মাংস ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যায় দিনের পর দিন।আর আপনাকে ৫০-১০০ টাকার মাছ কিনে খুশী থাকতে হয়। তখন স্বাভাবিক ভাবে আপনার অন্যায় ভাবে হলেও তা ক্রয় করার আগ্রহ জাগাটা স্বাভাবিক। এভাবেই দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। তাই আমাদের দেশ সহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি।
খ) আমাদের দেশে যারা উচ্চ শিক্ষার ও ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পায়, তাদের প্রায় সবাই ধনী পরিবারের সন্তান। তাই দেখা যায়, অফিসের কর্মকর্তারা প্রায় সবাই বংশগত বড় লোক। আবার নিম্নস্তরের কর্মচারীরা প্রায়ই বংশগত গরীব। আর তাদের প্রমোশনও উপরের স্তরের কর্মকর্তারা দিতে চায় না, বিভিন্ন অজুহাতে। ফলে সম্পদ ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে। যা ইসলামের অর্থনৈতিক মূল নীতি বিরোধী। এই নীতির কারণেও দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।
৯। নিম্নস্তরের লোকদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার উপায়
আমরা মনে করি, নিম্নস্তরের লোকদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য, রাসূল সঃ ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগের বেতন ও সুযোগ সুবিধার নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে, তাহল,
ক। বেতন বৈষম্য ১ঃ২ এ নামাতে হবে।
খ। সামাজিক সুযোগ সুবিধা সবার সমান করতে হবে। গ। দায়িত্বশীল বা ক্ষমতাশীলরা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় কাজে, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিতে পারবেন। এর বেশি সুবিধা তারা নিতে পারবে না।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল ক্ষেত্রে, পবিত্র কোরআন ও হাদীসের নিয়ম-নীতি মেনে, খাঁটি মুমিন হওয়ার তৌফিক দান করুন-আমিন।
0 মন্তব্যসমূহ