যাকাত
ইসলামী অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যাকাত আরবি শব্দ। এর অর্থ,
পবিত্র ও বৃদ্ধি। শরিয়তের পরিভাষায়, ধনীদের সম্পদের একটা নির্ধারিত অংশ বছর
শেষে রাষ্ট্রীয় ভাবে আদায় করে বাইতুল মালে জমা করাকে যাকাত বলে।" পবিত্র
কোরআনে যাকাতকে সদাকাহও বলা হয়েছে।
![]() |
যাকাত কি ও কেন? |
যাকাত
যাকাতের গুরুত্বঃ
১। যাকাত আদায় করা ফরজঃ
যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বহুবার মুমিনদের যাকাত দিতে বলেছেন।
ক) সূরা আল মু'মিনূন (المؤمنون), আয়াত: ৪
وَٱلَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَوٰةِ فَٰعِلُونَ
অর্থঃযারা যাকাত দান করে থাকে।
খ) সূরা আল বাকারা (البقرة), আয়াত: ৪৩
وَأَقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُوا۟ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرْكَعُوا۟ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ
অর্থঃআর নামায কায়েম কর, যাকাত দান কর এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে, যারা অবনত হয়।
২। যাকাত সম্পদকে পবিত্র ও বরকতময় করেঃ
যাকাত আদায় করলে, আল্লাহ তায়ালা সম্পদকে পবিত্র ও বরকতময় করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
সূরা আত-তাওবাহ্ (التوبة), আয়াত: ১০৩
خُذْ مِنْ أَمْوَٰلِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
অর্থঃতাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। আর তুমি তাদের জন্য দোয়া কর, নিঃসন্দেহে তোমার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ। বস্তুতঃ আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন।
৩। যাকাত অর্থনৈতিক এবাদতঃ
যাকাত একটি অর্থনৈতিক এবাদত।
হাদিসে এসেছেঃ
حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ مُوسَى، قَالَ أَخْبَرَنَا حَنْظَلَةُ بْنُ أَبِي سُفْيَانَ، عَنْ عِكْرِمَةَ بْنِ خَالِدٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ
ইবন ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সা) ইরশাদ করেন, ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি।
১. আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রসূল-এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা।
২. সলাত কায়িম করা।
৩. যাকাত আদায় করা।
৪. হাজ্জ সম্পাদন করা এবং
৫. রমযানের সিয়ামব্রত পালন করা (রোজা রাখা)।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৮)
এই পাঁচটির মধ্যে যাকাত অর্থনৈতিক এবাদত।
৪। যাকাত রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎসঃ
যাকাত রাষ্ট্রীয় ভাবে আদায়কৃত একটি ফরজ ইবাদত এবং রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ), আবু বকর (রাঃ), ওমর ফারুক (রাঃ), ওসমান (রাঃ), আলী (রাঃ) থেকে আব্বাসিয় শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ভাবে যাকাত আদায় করা হতো। রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা ঘরে ঘরে গিয়ে যাকাতের অর্থ আদায় করে নিয়ে আনতেন। আর তা বাইতুল মালে জমা হতো। সেখান থেকে সরকার ব্যয়ের খাতে খরচ করতেন।
রাজস্ব তথা বাইতুল মালের আয়ের সুন্নত উৎস মোট ১৯টা ।
উৎসগুলো হলঃ
১।যাকাত, ২।উশর, ৩।খারাজ, ৪।সাদাকাতুল ফিতর, ৫।ওয়াকফ, ৬।আমওয়াল আল ফাদিল বা অতিরিক্ত মাল, ৭।জরুরী কর, ৮। দান, ৯। গনিমত , ১০। খুমুস, ১১। ফাই, ১২। মুক্তিপণ, ১৩। কর্জ, ১৪। উপহার সামগ্রী, ১৫। জিযিয়া, ১৬। মালিকানাহীন সম্পদ, ১৭। একাধিকারভুক্ত ব্যবসায়ের কর, ১৮।জলজ সম্পদ, ১৯।বনজ সম্পদ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়,সেই সময়, শুধু যাকাত ও উশরের মাধ্যমে প্রায় ৯০% পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করা হতো। আর এখনও এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয় করা সম্ভব।
যাকাত কারা আদায় ও বিতরণ করবেঃ
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ( সঃ) থেকে শুরু করে আব্বাসীয় শেষ খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহ পর্যন্ত (৬২২-১২৫৮)খৃঃ সরকারি কর্মচারীগণ মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে যাকাত আদায় করে নিয়ে আসতো। আর রাষ্ট্র প্রধান বা তার প্রতিনিধির তা বিতরণ করার অধিকার ছিল।
যাকাত তথা বাইতুল মালের অর্থ কোথায় বিতরণ করবেঃ
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
সূরা আত-তাওবাহ্ (التوبة), আয়াত: ৬০
إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَٱلْمَسَٰكِينِ وَٱلْعَٰمِلِينَ عَلَيْهَا وَٱلْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِى ٱلرِّقَابِ وَٱلْغَٰرِمِينَ وَفِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبْنِ ٱلسَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ ٱللَّهِ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
অর্থঃযাকাত তথা বাইতুল মালের অর্থ, কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
এই আয়াতের প্রেক্ষিতে রাসূল সঃ, খোলাফায়ে রাশেদা এমনকি আব্বাসিয় খেলাফতের শেষ দিন পর্যন্ত একটানা ৬ শত বছরের বেশি সময় যাকাত তথা রাজস্ব ব্যয়ের খাতগুলো ছিল,
১। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা প্রদান, ২।দারিদ্র্য বিমোচন, ৩।দাসত্ব মোচন, ৪।ঋণমুক্তি, ৫।রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কাজে, ৬।রাস্তা -ঘাট ও পুল নির্মাণ, ৭।জনকল্যাণমুলক কার্যাবলি, ৮।প্রতিরক্ষা, ৯।কর্মসংস্থান, ১০। সুদমুক্ত কৃষিঋণ, ১১।ইসলাম প্রচার-প্রসার।
যাকাতের প্রচলিত পদ্ধতিঃ
১। যাকাতের বর্তমানে প্রচলিত সংজ্ঞাঃ
"ধনীদের সম্পদের একটা নির্ধারিত অংশ বছর শেষে দরিদ্রদের দান করাকে যাকাত বলে।"
এটা ইসলামের দেয়া সংজ্ঞার বিপরীত।
ইসলামী সংজ্ঞাঃ "ধনীদের সম্পদের একটা নির্ধারিত অংশ বছর শেষে রাষ্ট্রীয় ভাবে আদায় করে বাইতুল মালে জমা করাকে যাকাত বলে।"
২। যাকাত বর্তমানে ব্যক্তিগত ভাবে আদায় করেঃ
যাকাত ব্যক্তিগত ভাবে আদায় করার বিষয় নয়। ব্যক্তিগত ভাবে যা দান করা হয়, তা সবই সদাকাহ, যাকাত নয়। কারণ, সেই সময়, যাকাত বলা হতোঃ "ধনীদের সম্পদের একটা নির্ধারিত অংশ বছর শেষে রাষ্ট্রীয় ভাবে আদায় করে বাইতুল মালে জমা করাকে যাকাত বলে।"
এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, ব্যক্তিগত ভাবে আদায় করা সম্পদ যাকাত নয় সদাকাহ।
এখনকার পদ্ধতিতে আপনি যাকাত দিতে পারেন, কিন্তু নবীর তরিকায় আদায় হল না। আর নবীর তরিকায় আদায় নাকরা বিদয়াত।
যাকাত ব্যক্তিগত ভাবে আদায় করার নিয়ম রাসূল সঃ ও খোলাফায়ে রাশেদার কেহই চালু করেন নাই। তাই আমরা মনে করি, যাকাত ব্যক্তিগত ভাবে আদায় করা শিরক-বিদয়াত।তবে সদাকাহ যত খুশি দিতে পারেন। শুধু ২.৫% কেন , ৫,১০,৫০,১০০% পর্যন্ত দান বা সদাকাহ করা যায়।
যাকাত ব্যক্তিগত ভাবে আদায় করায়ঃ
যাকাত ব্যক্তিগত ভাবে আদায় করার কারণে, আমরা শিরক-বিদয়াতে লিপ্ত হচ্ছি। ফলে,
১। আমাদের খরচ দুই বার হচ্ছে। একবার সরকারকে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে, আরেকবার যাকাত দিতে হচ্ছে।
রাসূল সঃ ও খোলাফায়ে রাশেদার আমলে মুমিনগণ রাষ্ট্রকে শুধু মাত্র যাকাত ও উশর দিতেন আর অন্যকিছু দিতেন না। বিনিময়ে তারা পেত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা। আমরা দুই বার খরচ করতে চাই না আর শিরক-বিদায়াতেও লিপ্ত হতে চাই না।
২। ব্যক্তি পর্যায়ে যাকাত আদায়ের ফলে, যাকাতের শাড়ী-কাপড়-লুঙ্গীর আবিস্কার হয়েছে। যা গ্রহণ করতে প্রতি বছর অনেক লোক আহত-নিহত হয়।
৩। এর ফলে দারিদ্র কমার পরিবর্তে দিন দিন বাড়ছে।
৪। যা একটি ঐচ্ছিক যা-তা বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সরকার অত্যাচারী হলেও সরকারকেই যাকাত দিতে হবেঃ
সরকার জালেম বা অত্যাচারী হলেও সরকারকেই যাকাত দিতে হবে। কারণ উমাইয়া খেলাফতের মধ্যে ইয়াজিদ অত্যাচারী খলিফা হওয়ার পরেও সাহাবিগণ রাষ্ট্রকে যাকাত দিতেন। আর তাই রাষ্ট্রকে যাকাত দেয়া ফরজ।
সরকারি ভাবে যাকাত আদায় করা না হলেঃ
১। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করাঃ
সরকারি ভাবে যাকাত আদায় না হলে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করতে থাকবেন। আর একথা আছে সূরা বাকারা ২১৯নং আয়াতে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَيَسْـَٔلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ قُلِ ٱلْعَفْوَ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمُ ٱلْءَايَٰتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ
অর্থঃ আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কতটুকু তারা ব্যয় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্যে নির্দেশ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করতে পার।
২। সরকারকে জানাতে ও বুঝাতে হবেঃ
সরকারকে জানাতে ও বুঝাতে হবে যে, যাকাত রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস। রাসুল সঃ ও খোলাফায়ে রাশেদা রাঃ যাকাতের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করতেন। তাই যাকাতের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা সুন্নত। আর এর মাধ্যমে বর্তমানের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি রাজস্ব আয় করা সম্ভব।
৩। সঠিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবেঃ
এখনকার পদ্ধতিতে আপনি যাকাত দিতে পারেন, কিন্তু নবীর তরিকায় আদায় হল না। এটা জরুরী অবস্থায় আমল করলেও এটা সঠিক পদ্ধতি নয়, এটা মনে রাখতে হবে আর তাই আমাদের সঠিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে।
৪। যাকাত দিতে চাইলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারেই দিতে হবেঃ
আপনার যাকাত দেয়ার মত সম্পদ থাকলে, সরকারী কোষাগার তথা বাইতুল মালে যাকাত আদায় করবেন। এটাই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের আইন ও সুন্নত
একটি প্রশ্নঃ
যারা বলেন, সরকার যাকাত আদায় না করলে বা যাকাত গ্রহণ না করলে, ব্যক্তিগত ভাবে যাকাত দিতে হবে। তাদের নিকট আমার প্রশ্ন হল, ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার বাহিরে বিধর্মী রাষ্ট্রেও অনেক সাহাবী বসবাস করতেন। তাঁরা কি ব্যক্তিগত ভাবে যাকাত দিতেন? এবং কিভাবে দিয়েছেন?
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিকটা জানা, বুঝা ও মেনে চলার তৌফিক দান করুন - আমিন।
সূত্রঃ পবিত্র কুরআন, হাদীস শরীফ ও ইসলামের ইতিহাস।
0 মন্তব্যসমূহ