ঘুষ ও দুর্নীতি একটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি বাধা প্রাপ্ত হয়। আর মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যহত হয়।

ঘুষ ও দুর্নীতি দূর করার উপায়গুলো কি কি?

ঘুষ ও দুর্নীতি দূর করার উপায়
ঘুষঃ
কোন কাজ নিয়মবহির্ভূত ভাবে করে দেয়ার বিনিময়টা হল ঘুষ। আবার, কোন কাজের জন্য দ্বিতীয় বার বিনিময় নেয়া বা চাওয়া হল ঘুষ।
(১)রাসূল সা. বলেন, প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ হাদিয়া কবুল করলে চুরি বলে গণ্য হবে। (মুসনাদে আহমাদ ৪২৪)
(২)রাসূল সা. আরো বলেন, রাজা-বাদশাদের হাদিয়া গ্রহণ করা ঘুষের অন্তর্ভুক্ত। (তালখীসুল মুতাশাবিহ -৩৩১)
(৩)রাসূল সা. বলেন, ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ের উপরই আল্লাহর লানত
(ইবনে মাজা-২৩১৩)
হাদীসের ভাষায় ঘুষ কাকে বলে?
রাসূল সা. এর অন্য হাদীস দ্বারা ঘুষ বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়। আসাদ গোত্রের এক ব্যক্তিকে রাসূল সা. যাকাতের কাজে নিয়োগ দেন। তার নাম ছিল ইবনুল লুতাবিয়্যাহ। কাজ থেকে ফেরার পর বলল, এ হচ্ছে যাকাতের সম্পদ আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। তখন রাসূল সা. মিম্বারে ওপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তণের পর বললেন, আমার প্রেরিত কর্মচারীর কী হল, সে বলে, "এটা যাকাতের সম্পদ আর এটা আমি হাদিয়াস্বরূপ পেয়েছি।" সে তার বাপ-মার ঘরে বসে দেখতে পারে না তাকে হাদিয়া দেওয়া হয় কিনা?
আল্লাহর কসম করে বলছি তোমাদের কেউ খেয়ানত করলে তা নিজের কাঁধে নিয়েই কেয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হবে। উট, গরু, বা ছাগল যাই হোক সেগুলো আওয়াজ করতে থাকবে।
এরপর রাসূল সা. উভয় হাত উত্তোলন করে দু’বার বললেন, হে আল্লাহ! আমি পৌঁছে দিয়েছি। হাত উত্তলনের কারণে রাসূল সা. এর বগলের শুভ্রতা আমরা দেখতে পেলাম। (বুখারী-৬৫৭৮, ৮৮৩)
আমাদের সামনে স্পষ্ট হলো। সরকারী বা বেসরকারী কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়মিত বেতন/ভাতা পাওয়া সত্ত্বেও যদি বাড়তি কিছু গ্রহণ করে তাহলে তা ঘুষ হবে।
দুর্নীতিঃ
(১) নীতির বাইরে যা কিছু আছে, তাই দুর্নীতি।
অথবা (২) নীতি বিরোধী কাজই হল দুর্নীতি।
আবার (৩) কোন কাজ যথাযথ ভাবে না করাও দুর্নীতি।
যেমনঃ(১) আপনি শিক্ষক, আপনার পাঠ দেবার কথা এক ঘন্টা। আপনি ক্লাসে আসলেন ১০ মিনিট পর। গল্প করলেন ১০ মিনিট। কিছুক্ষণ পড়ালেন। ১০ মিনিট আগে ছেড়ে দিলেন। দুর্নীতি।
(২) আপনি রাঁধুনি, স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করা আপনার কাজ। আপনি অস্বাস্থ্যসম্মত ভাবে রান্না শেষ করলেন। দুর্নীতি।
(৩) আপনি সেনা কর্মকর্তা, ব্যাংকে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে আগে ঢুকে গেলেন, দুর্নীতি।
(৪) আপনি চালক, গাড়ি চালানোর পাশাপাশি তার রক্ষণাবেক্ষণও আপনার দায়িত্ব। আপনি ভাঙা রাস্তার তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো চালালেন, দুর্নীতি।
(৫) আপনি গায়ক, কোন চর্চা ছাড়া আপনি স্টুডিওতে গিয়ে বেসুরো গেয়ে দিয়ে চলে আসলেন, দুর্নীতি।
(৬) আইন সবার জন্য সমান, কিন্তু আপনি কিছু লোককে বিশেষ সুবিধা দিলেন, দুর্নীতি।
(৭) আপনাকে কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, আপনি তা ঠিক ভাবে করতেছেন না বা করতে পারছেন না, তবুও চেয়ারে বসে আছেন,পদত্যাগ করছেন না, দুর্নীতি।
(৮) আপনি দুর্নীতি করার পরিবেশ তৈরী করলেন, অথবা সহ্য করেন, দুর্নীতি।
(৯) এবাদতে দুর্নীতি: যেভাবে এবাদত করার কথা সেভাবে না করাই এবাদতে দুর্নীতি।
যেমনঃ ১। নামায রাষ্ট্রপতি পড়ানো সুন্নত বা নিয়ম, সে নিয়মে পড়া হচ্ছে না, দুর্নীতি। *বিস্তারিতঃ
২। যাকাত রাষ্ট্রীয় ভাবে আদায় করার কথা, সেভাবে আদায় হচ্ছে না, দুর্নীতি। *বিস্তারিতঃ
৩। হজ্বে মুসলিম জাহানের নেতা বক্তৃতা দেয়ার কথা, তিনি তা দিচ্ছেন না, দুর্নীতি। *বিস্তারিতঃ এগুলো সব এবাদতে দুর্নীতি।
নীতিঃ
১। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল যেসব নিয়ম- নীতি আমাদের দিয়েছেন, তাই নীতি।
২। সবার জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য হয়, এমন সব আইন হল নীতি।
৩। সবার অবশ্যই পালনীয় নির্দেশনাকে নীতি বলে।
নীতি সঠিকতার মানদণ্ডঃ
নীতি সঠিকতার মানদণ্ড ২টি।
১। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সঃ এর আদেশ, নিষেধ ও অনুমোদন ইত্যাদি।
২। অধিকাংশ জনগণের মতামত।
ঘুষ ও দুর্নীতির মূল কারণঃ
ঘুষ ও দুর্নীতির মূল কারণ দুটি। ১। বেতন ও সুযোগ সুবিধার চরম বৈষম্য। ২। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব।
১। বেতন ও সুযোগ সুবিধার চরম বৈষম্যঃ
বেতন ও সুযোগ সুবিধার বৈষম্য কম থাকলে দুর্নীতি কমে যায়।উন্নত দেশগুলোতে সরকারি কর্মচারীদের বেতনের অনুপাত সর্বোচ্চ ১ঃ৫/৬। আর সুযোগ সুবিধা প্রায় কাছাকাছি।তাই উন্নত দেশগুলোতে দুর্নীতি অনেক কম। সেখানে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা প্রায় ১ঃ১০ বা তারচেয়ে বহুগুণ বেশি। ফলে এদেশগুলোর দুর্নীতি অনেক বেশি।
ইসলাম বলে, "বেতন বৈষম্য সর্বোচ্চ ১ঃ২ এর মধ্যে থাকতে হবে। আর সুযোগ সুবিধার কোন বৈষম্য করা যাবে না।আবার প্রেসিডেন্টের যে সুযোগ সুবিধা একজন সাধারণ নাগরিকেরও একই সুযোগ সুবিধা। *বিস্তারিতঃ
২। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবঃ
সামাজিক নিরাপত্তা বাড়লে দুর্নীতি কমে যায়। সামাজিক নিরাপত্তা না থাকলে মানুষ নিজের নিরাপত্তা নিজেই তৈরী করার চেষ্টা থেকেই লোভী হয়ে পড়ে। সিঙ্গাপুরের মানুষ অর্থ জমা করে না। তারা সপ্তাহের টাকা সপ্তাহে খরচ করে ফেলে।তাদের মৌলিক চাহিদা সরকার পূরণ করে।যেমন অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি।তারা শুধু অন্ন ও বস্ত্রটা নিজে কিনে বাকীটা সরকার দেখে।
ইসলামের দৃষ্টিতে সমাধানঃ
ইসলাম বলে, নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার দায়িত্ব সরকারের। সব উন্নত দেশে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব সরকার নেয়। তাই তারা বর্তমান মুসলিমদের থেকে বেশি সভ্য। তাদের লোভও কম। তারা ঘুষ খায় না, কারো টাকা মেরেও খায় না। তারা বলে, "আমি এত টাকা দিয়ে কি করব"? আমার সবকিছু তো সরকার দিচ্ছে। এটা ইসলামেরই নীতি।
সামাজিক নিরাপত্তা বাড়লে দু্র্নীতি বিদায় নেয়ঃ
সামাজিক নিরাপত্তা বাড়লে, মানুষের লোভ ও চাহিদা কমে যায়। ফলে দু্র্নীতি বিদায় নিয়ে সমাজ পবিত্র হয়ে যায়।
শাস্তি দিলে ভয়ে ভাল আচরণ করবে কিন্তু তার চাহিদা সীমিত করে দিলে, সে টাকা খরচ করার পথ না পেয়ে, তা ছেড়ে দায়িত্ববান হয়ে উঠবে। আর এই পদ্ধতিই বেচে নিয়েছে সিঙ্গাপুর সহ উন্নত দেশগুলো। তাদের অন্ন,বস্ত্র ছাড়া বাকি সব দিচ্ছে সরকার। কেহ চাইলেও এই দু'টা ছাড়া অন্য কিছু করতে/ কিনতে পারে না। তা হলে তারা টাকা দিয়ে কি করবে? টয়লেটে ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নাই।
ফিনল্যান্ডে টাকার বস্তা রাস্তায় ফেলে রেখে জনগণের আচরণ লক্ষ্য করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ফেলে রাখার পরেও দেখা গেল, কেউ সেদিকে কোন মনোযোগ দেয় নি। কারণ তাদের চাহিদা সরকারিভাবে সীমিত করে দেয়া হয়েছে। তাই তারা আজ সভ্য জাতি।
আপনি আজকে ধনী, কাল আপনার বড় কোন রোগ যদি ধরা পরে, ফকির হতে বেশি দিন লাগবে না। প্রতি বছর চিকিৎসা করতে গিয়ে বাংলাদেশের কয়েক লক্ষ লোক পথের ফকির হয়ে যায়। আর সামাজিক নিরাপত্তা থাকলে তা হওয়ার কোন ঝুকি নাই। তাহলে ধনীগণ কেন তাদের নিরাপত্তা আরো বৃদ্ধি করবে না?
ঘুষ ও দুর্নীতির জন্য দায়ী অন্যান্য কারণ দূর করার উপায়ঃ
১। জনগনকে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া।
২। নীতি বা আইন সবার জন্য সমান ভাবে প্রয়োগ করা।
৩। আইন অমান্যকারীকে শাস্তি দেয়া।
৪। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৫। পরিবার পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পরিবারে বাচ্চা কম তারা নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে বেশি যত্নশীল।অর্থাৎ পারিবারিক শিক্ষাটা এখানে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
উদাহরণঃ জাপানে ঘুর্ণিঝড়ের পর ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, এক সাংবাদিক লাইনের অনেক পেছনে থাকা ছেলেকে ত্রাণের একটা পেকেট এনে দিল। কারণ সাংবাদিক দেখলো যে পরিমাণ ত্রাণ আছে তাতে সবাই পাবে না। তাই তিনি তার পেকেটটা তার হাতে দিল। ছেলেটা তা না নিয়ে, সামনে গিয়ে যেখান থেকে ত্রাণ দেয়া হয় সেখানে দিয়ে আসলো। ছেলেটাকে এবিষয়ে জিজ্ঞেসা করলে, সে বলল, আমার আগে অনেকে আছে। তাদের বাদ দিয়ে আমি নেয়া বেআইনি। যারা না পাবে তাদের জন্য সরকার আরো ত্রাণের ব্যবস্থা করবে।
আমাদের দেশের প্রায় ৯৮% লোক কোন না কোন অপরাধের সাথে জড়িত। তাদের সবাইকে শাস্তি দেয়া কি সম্ভব? তাহলে এমন একটা পথ বেচে নিতে হবে, যাতে তারা অপরাধ করা ছেড়ে দেয়। আর উন্নত দেশগুলো সেই পথে হাঁটছে, তাহলে আমরা কেন নয়?
উন্নত মানসিকতাই উন্নত সমাজ গড়তে পারে। রাসূল সঃ পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে দেশ থেকে সহজে ঘুষ ও দুর্নীতি দূর করে ছিলেন। আমরাও সেই পথে হাঁটলে ঘুষ ও দুর্নীতি দেশ থেকে সহজে দূর করতে পারবো।
বর্তমানে উন্নত অমুসলিম দেশগুলো ইসলামের প্রায় ৯০% নিয়ম নীতির অনুসরণ করে, আর মুসলিম দেশগুলো মাত্র প্রায় ১০% ইসলামের নিয়ম নীতির অনুসরণ করে। ফলে বর্তমানে মুসলিম দেশগুলো থেকে উন্নত অমুসলিম দেশগুলো বসবাসের জন্য বেশি নিরাপদ।
অতএব, ঘুষ ও দুর্নীতি সহজে দূর করতে আমাদের ইসলামের নিয়ম-নীতির অনুসরণ করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের ইসলামের নিয়ম নীতি অনুসরণ করে দেশ থেকে ঘুষ ও দুর্নীতি দূর করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
0 মন্তব্যসমূহ